গীতা তৃতীয় অধ্যায় - কর্ম যোগ

ভগবৎ গীতার তৃতীয় অধ্যায়ে ভগবান কৃষ্ণ কর্ম যোগের বিষয়ে বলেছেন। সমস্ত শ্লোকের অনুবাদ  অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ এর গীতা যথাযথ থেকে নেওয়া। 

গীতা তৃতীয় অধ্যায় - কর্ম যোগ
গীতা তৃতীয় অধ্যায় - কর্ম যোগ


আমরা প্রথম অধ্যায় এ জেনেছি অর্জুন যুদ্ধক্ষেত্রে নিজের পরিচিতদের দেখে বিষাদগ্রস্থ হয়ে পড়েন। অর্জুন যখন যুন্ধ না করার জন্য মনস্থ করেন তখন ভগবান কৃষ্ণ অর্জুনকে কেন যুদ্ধ করা উচিত তা বলেন দ্বিতীয় অধ্যায়ে। 


সমস্ত শ্লোকের অনুবাদ :-

শ্লোক ৩.১:

অর্জুন বললেন-হে জনার্দন! হে কেশব! যদি তোমার মতে  কর্ম অপেক্ষা ভক্তি-বিষয়িনী বুদ্ধি শ্রেয়তর হয়, তাহলে এই ভয়ানক যুদ্ধে নিযুক্ত হওয়ার জন্য কেন আমাকে প্ররোচিত করছ?

শ্লোক ৩.২:

vyāmiśreṇeva vākyena
buddhiṁ mohayasīva me
tad ekaṁ vada niścitya
yena śreyo ’ham āpnuyām

তুমি যেন দ্ব্যর্থবোধক বাক্যের দ্বারা আমার বুদ্ধি  বিভ্রান্ত করছ। তাই, দয়া করে আমাকে নিশ্চিতভাবে বল কোনটি আমার পক্ষে সবচেয়ে শ্রেয়স্কর।

শ্লোক ৩.৩:

পরমেশ্বর ভগবান বললেন-হে নিষ্পাপ অর্জুন! আমি ইতিপূর্বে ব্যাখ্যা করেছি যে, দুই প্রকার মানুষ আত্ম-উপলব্ধি করতে চেষ্টা করে। কিছু লোক অভিজ্ঞতালব্ধ আবার তা ভক্তির মাধ্যমে জানতে চান।

শ্লোক ৩.৪:

কেবল কর্মের অনুষ্ঠান না করার মাধ্যমে কর্মফল থেকে মুক্ত হওয়া যায় না, আবার কর্মত্যাগের মাধ্যমেও সিদ্ধি লাভ করা যায় না।

শ্লোক ৩.৫:

সকলেই মায়াজাত গুণসমূহের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অসহায়ভাবে কর্ম করতে বাধ্য হয়; তাই কর্ম না করে কেউই ক্ষণকালও থাকতে পারে না।

শ্লোক ৩.৬:

যে ব্যক্তি পঞ্চ-কর্মেন্দ্রিয় সংযত করেও মনে মনে শব্দ,রস আদি ইন্দ্রিয় বিষয়গুলি স্মরণ করে, সেই মূঢ় অবশ্যই নিজেকে বিভ্রান্ত করে এবং তাকে মিথ্যাচারী ভন্ড বলা হয়ে থাকে।

শ্লোক ৩.৭:

কিন্তু যিনি মনের দ্বারা ইন্দ্রিয়গুলিকে সংযত করে অনাসক্তভাবে কর্মযোগের অনুষ্ঠান করেন, তিনি পূর্বোক্ত মিথ্যাচারী অপেক্ষা অনেক গুণে শ্রেষ্ঠ।

শ্লোক ৩.৮:

niyataṁ kuru karma tvaṁ
karma jyāyo hy akarmaṇaḥ
śarīra-yātrāpi ca te
na prasidhyed akarmaṇaḥ

তুমি শাস্ত্রোক্ত কর্মের অনুষ্ঠান কর, কেন না কর্মত্যাগ থেকে কর্মের অনুষ্ঠান শ্রেয়। কর্ম না করে কেউ দেহযাত্রাও নির্বাহ করতে পারে না।

শ্লোক ৩.৯:

yajñārthāt karmaṇo ’nyatra
loko ’yaṁ karma-bandhanaḥ
tad-arthaṁ karma kaunteya
mukta-saṅgaḥ samācara

বিষ্ণুর প্রীতি সম্পাদন করার জন্য কর্ম করা উচিত; তা না হলে কর্মই এই জড় জগতে বন্ধনের কারণ। তাই, হে কৌন্তেয়! ভগবানের সন্তুষ্টি বিধানের জন্যই কেবল তুমি তোমার কর্তব্যকর্ম অনুষ্ঠান কর এবং এভাবেই তুমি সর্বদাই বন্ধন থেকে মুক্ত থাকতে পারবে।

শ্লোক ৩.১০:

সৃষ্টির প্রারম্ভে সৃষ্টিকর্তা যজ্ঞাদি সহ প্রজাসকল সৃষ্টি করে বলেছিলেন-“এই যজ্ঞের দ্বারা তোমরা উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ হও। এই যজ্ঞ তোমাদের সমস্ত অভীষ্ট পূর্ণ করবে।”

শ্লোক ৩.১১:

তোমাদের যজ্ঞ অনুষ্ঠানে প্রীত হয়ে দেবতারা তোমাদের প্রীতি সাধন করবেন। এভাবেই পরস্পরের প্রীতি সম্পাদন করার মাধ্যমে তোমরা পরম মঙ্গল লাভ করবে।

শ্লোক ৩.১২:

যজ্ঞের ফলে সন্তুষ্ট হয়ে দেবতারা তোমাদের বাঞ্ছিত ভোগ্যবস্তু প্রদান করবেন। কিন্তু দেবতাদের প্রদত্ত বস্তু তাঁদের নিবেদন না করে যে ভোগ করে, সে নিশ্চয়ই চোর।

শ্লোক ৩.১৩:

ভগবদ্ভক্তেরা সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত হন, কারণ তাঁরা যজ্ঞাবশিষ্ট অন্নাদি গ্রহণ করেন। যারা কেবল স্বার্থপর হয়ে নিজেদের ইন্দ্রিয়ের তৃপ্তির জন্য অন্নাদি পাক করে, তারা কেবল পাপই ভোজন করে।

শ্লোক ৩.১৪:

annād bhavanti bhūtāni
parjanyād anna-sambhavaḥ
yajñād bhavati parjanyo
yajñaḥ karma-samudbhavaḥ

অন্ন খেয়ে প্রাণীগণ জীবন ধারণ করে। বৃষ্টি হওয়ার ফলে অন্ন উৎপন্ন হয়। যজ্ঞ অনুষ্ঠান করার ফলে বৃষ্টি উৎপন্ন হয় এবং শাস্ত্রোক্ত কর্ম থেকে যজ্ঞ উৎপন্ন হয়।

শ্লোক ৩.১৫:

যজ্ঞাদি কর্ম বেদ থেকে উদ্ভত হয়েছে এবং বেদ অক্ষর বা পরমেশ্বর ভগবান থেকে প্রকাশিত হয়েছে। অতএব সর্বব্যাপক ব্রহ্ম সর্বদা যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিত আছেন।

শ্লোক ৩.১৬:

হে অর্জুন! যে ব্যক্তি এই জীবনে বেদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত যজ্ঞ অনুষ্ঠানের পন্থা অনুসরণ করে না, সেই ইন্দ্রিয়সুখ-পরায়ণ পাপী ব্যক্তি বৃথা জীবন ধারণ করে।

শ্লোক ৩.১৭:

কিন্তু যে ব্যক্তি আত্মাতেই প্রীত, আত্মাতেই তৃপ্ত এবং আত্মাতেই সন্তুষ্ট, তাঁর কোন কর্তব্যকর্ম নেই।

শ্লোক ৩.১৮:

আত্মানন্দ অনুভবকারী ব্যক্তির এই জগতে ধর্ম অনুষ্ঠানের কোন প্রয়োজন নেই এবং এই প্রকার কর্ম না করারও কোন কারণ নেই। তাকে অন্য কোন প্রাণীর উপর নির্ভর করতেও হয় না।

শ্লোক ৩.১৯:

অতএব, কর্মফলের প্রতি আসক্তি রহিত হয়ে কর্তব্যকর্ম সম্পাদন কর। অনাসক্ত হয়ে কর্ম করার ফলেই মানুষ পরতত্ত্বকে লাভ করতে পারে।

শ্লোক ৩.২০:

karmaṇaiva hi saṁsiddhim
āsthitā janakādayaḥ
loka-saṅgraham evāpi
sampaśyan kartum arhasi

জনক আদি রাজারাও কর্ম দ্বারাই সংসিদ্ধি প্রাপ্ত হয়েছিলেন। অতএব, জনসাধারণকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য তোমার কর্ম করা উচিত।

শ্লোক ৩.২১:

yad yad ācarati śreṣṭhas
tat tad evetaro janaḥ
sa yat pramāṇaṁ kurute
lokas tad anuvartate

শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি যেভাবে আচরণ করেন, সাধারণ মানুষেরা তার অনুকরণ করে। তিনি যা প্রমাণ বলে স্বীকার করেন, সমগ্র পৃথিবী তারেই অনুসরণ করে।

শ্লোক ৩.২২:

হে পার্থ! এই ত্রিজগতে আমার কিছুই কর্তব্য নেই। আমার অপ্রাপ্ত কিছু নেই এবং প্রাপ্তব্যও কিছু নেই। তবুও আমি কর্মে ব্যাপৃত আছি।

শ্লোক ৩.২৩:

হে পার্থ! আমি যদি অনলস হয়ে কর্তব্যকর্মে প্রবৃত্ত না হই, তবে আমার অনুবর্তী হয়ে সমস্ত মানুষই কর্ম ত্যাগ করবে।

শ্লোক ৩.২৪:

আমি যদি কর্ম না করি, তা হলে এই সমস্ত লোক উৎসন্ন হবে। আমি বর্ণসঙ্কর সৃষ্টির কারণ হব এবং তার ফলে আমার দ্বারা সমস্ত প্রজা বিনষ্ট হবে।

শ্লোক ৩.২৫:

হে ভারত! অজ্ঞানীরা যেমন কর্মফলের প্রতি আসক্ত হয়ে তাদের কর্তব্যকর্ম করে, তেমনই জ্ঞানীরা অনাসক্ত হয়ে মানুষকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য কর্ম করবেন।

শ্লোক ৩.২৬:

জ্ঞানবান ব্যক্তিরা কর্মাসক্ত জ্ঞানহীন ব্যক্তিদের বুদ্ধি বিভ্রান্ত করবেন না। বরং, তাঁরা ভক্তিযুক্ত চিত্তে সমস্ত কর্ম অনুষ্ঠান করে জ্ঞানহীন ব্যক্তিদের কর্মে প্রবৃত্ত করবেন।

শ্লোক ৩.২৭:

prakṛteḥ kriyamāṇāni
guṇaiḥ karmāṇi sarvaśaḥ
ahaṅkāra-vimūḍhātmā
kartāham iti manyate

অহঙ্কারে মোহাচ্ছন্ন জীব জড়া প্রকৃতির ত্রিগুণ দ্বারা ক্রিয়মাণ সমস্ত কার্যকে স্বীয় কার্য বলে মনে করে ‘আমি কর্তা’-এই রকম অভিমান করে।

শ্লোক ৩.২৮:

হে মহাবাহো! তত্ত্বজ্ঞ ব্যক্তি ভগবদ্ভক্তিমুখী কর্ম ও সকাম কর্মের পার্থক্য ভালভাবে অবগত হয়ে কখনও ইন্দ্রিয়সুখ ভোগাত্মক কার্যে প্রবৃত্ত হন না।

শ্লোক ৩.২৯:

জড়া প্রকৃতির গুণের দ্বারা মোহাচ্ছন্ন হয়ে, অজ্ঞান ব্যক্তিরা জাগতিক কার্যকলাপে প্রবৃত্ত হয়। কিন্তু তাদের কর্ম নিকৃষ্ট হলেও তত্ত্বজ্ঞানী পুরুষেরা সেই মন্দবুদ্ধি ও অল্পজ্ঞ ব্যক্তিগণকে বিচলিত করেন না।

শ্লোক ৩.৩০:

অতএব, হে অর্জুন! অধ্যাত্মচেতনা-সম্পন্ন হয়ে তোমার সমস্ত কর্ম আমাকে সমর্পণ কর এবং মমতাশূন্য, নিষ্কাম ও শোকশূন্য হয়ে তুমি যুদ্ধ কর।

শ্লোক ৩.৩১:

আমার নির্দেশ অনুসারে যে - সমস্ত মানুষ তাঁদের কর্তব্যকর্ম অনুষ্ঠান করেন এবং যাঁরা শ্রদ্ধাবান ও মাৎসর্য রহিত হয়ে এই উপদেশ অনুসরণ করেন, তাঁরাও কর্মবন্ধন থেকে মুক্ত হন।

শ্লোক ৩.৩২:

কিন্তু যারা অসূয়াপূূর্বক আমার এই উপদেশ পালন করে না, তাদেরকে সমস্ত জ্ঞান থেকে বঞ্চিত, বিমূঢ় এবং পরমার্থ লাভের সকল প্রচেষ্টা থেকে ভ্রষ্ট বলে জানবে।

শ্লোক ৩.৩৩:

জ্ঞানবান ব্যক্তিও তাঁর স্বভাব অনুসারে কার্য করেন, কারণ প্রত্যেকেই ত্রিগুণজাত তাঁর স্বীয় স্বভাবকে অনুগমন করেন। সুতরাং নিগ্রহ করে কি লাভ হবে?

শ্লোক ৩.৩৪:

সমস্ত জীবই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুতে আসক্তি অথবা বিরক্তি অনুভব করে, কিন্তু এভাবে ইন্দ্রিয় ও ইন্দ্রিয়ের বিষয়ের বশীভূত হওয়া উচিত নয়, কারণ তা পারমার্থিক প্রগতির পথে প্রতিবন্ধক।

শ্লোক ৩.৩৫:

স্বধর্মের অনুষ্ঠান দোষযুক্ত হলেও উত্তমরূপে অনুষ্ঠিত পরধর্ম থেকে উৎকৃষ্ট। স্বধর্ম সাধনে যদি মৃত্যু হয়, তাও মঙ্গলজনক, কিন্তু অন্যের ধর্মের অনুষ্ঠান করা বিপজ্জনক।

শ্লোক ৩.৩৬:

অর্জুন বললেন- হে বার্ষ্ণেয়! মানুষ কার দ্বারা চালিত হয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও যেন বলপূর্বক নিয়োজিত হয়েই পাপাচরণে প্রবৃত্ত হয়?

শ্লোক ৩.৩৭:

śrī-bhagavān uvāca
kāma eṣa krodha eṣa
rajo-guṇa-samudbhavaḥ
mahāśano mahā-pāpmā
viddhy enam iha vairiṇam

পরমেশ্বর ভগবান বললেন- হে অর্জুন! রজোগুণ থেকে সমুদ্ভত কামই মানুষকে এই পাপে প্রবৃত্ত করে এবং এই কামই ক্রোধে পরিণত হয়। কাম সর্বগ্রাসী ও পাপাাত্মক; কামকেই জীবের প্রধান শত্রূ বলে জানবে।

শ্লোক ৩.৩৮:

অগ্নি যেমন ধূম দ্বারা আবৃত্ত থাকে, দর্পণ যেমন ময়লার দ্বারা আবৃত্ত থাকে অথবা গর্ভ যেমন জরায়ুর দ্বারা আবৃত থাকে, তেমনই জীবাত্মা বিভিন্ন মাত্রায় এই কামের দ্বারা আবৃত থাকে।

শ্লোক ৩.৩৯:

কামরূপী চির শত্রূর দ্বারা জীবের শুদ্ধ চেতনা আবৃত হয়। এই কাম দুর্বারিত অগ্নির মতো চিরঅতৃপ্ত।

শ্লোক ৩.৪০:

ইন্দ্রিয়সমূহ, মন ও বুদ্ধি এই কামের আশ্রয়স্থল। এই ইন্দ্রিয় আদির দ্বারা কাম জীবের প্রকৃত জ্ঞানকে আচ্ছন্ন করে তাকে বিভ্রান্ত করে।

শ্লোক ৩.৪১:

tasmāt tvam indriyāṇy ādau
niyamya bharatarṣabha
pāpmānaṁ prajahi hy enaṁ
jñāna-vijñāna-nāśanam

অতএব, হে ভরতশ্রেষ্ঠ! তুমি প্রথমে ইন্দ্রিয়গুলিকে নিয়ন্ত্রিত করে জ্ঞান ও বিজ্ঞান-নাশক পাপের প্রতীকরূপ এই কামকে বিনাশ কর।

শ্লোক ৩.৪২:

স্থুল জড় পদার্থ থেকে ইন্দ্রিয়গুলি শ্রেয়; ইন্দ্রিয়গুলি থেকে মন শ্রেয়; মন থেকে বুদ্ধি শ্রেয়; আর তিনি  (আত্মা) সেই বুদ্ধি থেকেও শ্রেয়।

শ্লোক ৩.৪৩:

evaṁ buddheḥ paraṁ buddhvā
saṁstabhyātmānam ātmanā
jahi śatruṁ mahā-bāho
kāma-rūpaṁ durāsadam

হে মহাবীর অর্জুন! নিজেকে জড় ইন্দ্রিয়, মন ও বুদ্ধির অতীত জেনে, নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধির দ্বারা মনকে স্থির কর এবং এভাবেই চিৎ-শক্তির দ্বারা কামরূপ দুর্জয় শত্রুকে জয় কর।


                        গীতা তৃতীয় অধ্যায় - কর্ম যোগ সমাপ্ত